প্রতারক চেনার উপায়


প্রতারক চেনার উপায়

 
মানুষ প্রতারণা করে থাকে সাধারণত কোন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কিংবা কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে। স্বার্থ বলতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ, মান-মর্যাদা ও প্রতিপত্তি লাভের স্বার্থ কিংবা ক্ষমতা লাভের স্বার্থ। আর কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য বা প্রতিহিংসাটা ব্যক্তিগত স্বার্থহানির জন্যও হতে পারে; আবার ধর্মীয়, জাতিগত বা রাজনৈতিক কারণেও হতে পারে। তবে যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, প্রতারকদের কিছু কমন আচরণগত আলামত ও বৈশিষ্ট্য থাকে; যা চেনা থাকলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় যেকোন পর্যায়েই প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকা যাবে। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অর্থ হারানো থেকেও বাঁচা যাবে, দ্বীন হারানো থেকেও বাঁচা যাবে, কারো প্ররোচনায় কোন নিরপরাধ আপনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পরে অনুতপ্ত হওয়ার আশংকা থেকেও নিরাপদ থাকা যাবে।
(১) বেশি কথা বলা
(২) নিজের সততা ও সত্যবাদিতা জাহির করা

(৩) বেশি বেশি শপথ করা
(৪) অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক কথাবার্তা
(৫) নিজের দু:খের কথা বলে মানুষের কাছে সহানুভূতি আদায় করা
(৬) উদ্দেশ্য প্রকাশে মিথ্যাচার
(৭) মনগড়া তত্ত্বের প্রচার
(৮) সত্য গোপন ও সত্যের বিপরীত তথ্য প্রকাশ
(৮) দ্বিমুখী ভূমিকা ও আচরণ
(৭) নিজের সন্তানের চেয়ে অন্যদের কিংবা বাচ্চাদের চেয়ে বড়দের প্রতি বেশি দরদী হওয়া
(৮) স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে একেক সময় একেক রকম আচরণ করা
(৯) মানুষের উপকারের চেয়ে মানুষকে পটানোর কাজে বেশি মনোযোগী হওয়া
(১০) উপকারের বিনিময়ে থাকার ও ঘাঁটি গাড়ার সুযোগ অন্বেষণ করা অথবা কোন স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা আদায় করা
(১১) বার বার ক্ষমা চাওয়া
(১২) পরিবারের ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের সাথে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা
(১৩) মানবসৃষ্ট দুর্যোগকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে হালকা করার প্রবণতা
(১) ব্যবসায়ী, ডাক্তার, রাজনীতিবিদ যাদেরকেই প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত বকবক করতে দেখবেন, তাদের থেকে দূরে থাকবেন। যারা সত্যিকার কাজের, তারা শুধু সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন ততটুকুই বলবে। বড়জোর ধর্ম ও দেশ নিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কুশলাদি নিয়ে কিছু কথাবার্তা ও খোঁজখবর নিতে পারে। কিন্তু কাউকে যদি দেখেন আগ বাড়িয়ে যেচে শুধু ক্রেতা ও সার্ভিস গ্রহীতার প্রতি অনাবশ্যক তোষামোদ ও গুণকীর্তন করছে, কিংবা নিজের ব্যবসায়িক ও পারিবারিক সুনাম ও সততা নিয়ে গল্প জুড়ে দিচ্ছে বা অন্যদের বদনাম ও গোষ্ঠী উদ্ধার করছে, তাহলে বুঝবেন something is wrong। এমন লোকের খপ্পরে পড়লে আর কিছু খোয়ানোর আগে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কেটে পড়ুন।
(২)
(৩)
(৪) প্রতারক ব্যক্তিরা নিজেদের এতিম, বিধবা বা সন্তানহারা হওয়ার কথা বলে; নিজের জীবনের দু:খের কাহিনী বর্ণনা করে মানুষের কাছে নিজেকে দু:খী, মজলুম, বঞ্চিত ও অবহেলিত হিসেবে তুলে ধরে এবং নিজের অনুকূলে মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করে। নিজের জীবনের কোন করুণ কাহিনী মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করে মানুষের দৃষ্টি ও নেক নজর আকর্ষণ করে এবং সেই সাথে অন্য কারো দু:খ-দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা জানিয়ে নিজের ও তার মধ্যে সাদৃশ্য প্রদর্শন করে এবং উভয়ে একই রকম মজলুম বলে পারস্পরিক ঐক্য ও সহযোগিতা গড়ে তোলার তাগিদ দেয়। কিন্তু কেউ নিজে কারো হাতে নির্যাতিত হয়েছিল বলেই তাকে অন্য কোন নিরপরাধ মানুষের উপর জুলুম করার সুযোগ ও অনুমতি দিয়ে তার ক্ষতি ও কষ্টটা পুষিয়ে নেবার ব্যবস্থা/বন্দোবস্ত করে দিতে হবে— এমন আবদার যুক্তিসঙ্গত নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইহুদী জাতি হলোকাস্টের ঘটনা বর্ণনা করে পশ্চিমা বিশ্বের জনমতকে নিজেদের পক্ষে নিতে এবং নিজেদের অন্যায়-অত্যাচারের পক্ষে পশ্চিমা শাসকদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। আর পারিবারিক ক্ষেত্রেও কোন কোন ব্যক্তিকে নিজের দু:খের কথা শুনিয়ে নিজের অনুকূলে সহানুভূতি অর্জনপূর্বক নিজের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও অশুভ তৎপরতার পক্ষে পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের অন্ধ সমর্থন আদায় করতে দেখা গেছে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে।
(৫) মিথ্যাবাদী ও প্রতারক স্বভাবের লোকেরা কোন ব্যাপারে নিজেদের স্বার্থ বা আসল উদ্দেশ্যের কথা না বলে অন্য কোন সৎ উদ্দেশ্যের কথা দাবি করে থাকে এবং মানুষের ভাল করার কথা বলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। মিথ্যাচার ও প্রতারণায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে রাজনীতিবিদরা। তারা নিজেদের ক্ষমতার জন্য কাজ করলেও যা কিছু করে সব জনগণের দোহাই দিয়ে করে। জনগণের ভোটাধিকার (ভোটের প্রাপকটা কে হবে সেটা দেখলেই বোঝা যায় গরজটা কার), জনগণের স্বার্থ এসব নিয়েই তাদের যত দরদ ও পেরেশানী! অথচ এটা পাগলেও বোঝে যে, জনগণের জন্য নিজেদের জান-মাল দিয়ে চেষ্টা-সাধনা করবার মতন মানুষ যদি দেশের নেতা হতো, এরা যদি এমন দয়ালু দাতা হাজী মোহসিনই হতো, তাহলে দেশটা বেহেশত হয়ে যেত। এরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাবে কোন্‌ দু:খে? সাধারণ মানুষের মধ্যেও কারো কারো চরিত্রে নিজের স্বার্থে মানুষের কল্যাণকামনার দাবি করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন- ছেলের বউ বাপের বাড়ি গেলে নিজেদের সাংসারিক কাজে ও রসনা বিলাসের ক্ষেত্রে সমস্যা হলেও সেটা ওভাবে না বলে বেড়াতে গেলে বাচ্চার শরীর খারাপ করবে কিনা ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা। কিংবা ছেলের বউ সকালে ঘুম থেকে না উঠলে সকালের নাস্তা তৈরিতে সমস্যা হলেও সেটা প্রকাশের পরিবর্তে গর্ভাবস্থায় সকালের সূর্য দেখার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা আর বাচ্চার শৈশবকালে বাচ্চা সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস না করলে স্কুলে যাবার বয়স হলে স্কুলে যেতে সমস্যা হবে কিনা সেই উপদেশ বিলানো। অথবা বাচ্চার দুধের পিছনে টাকা খরচ করাটা অনাকাঙ্ক্ষিত হওয়ায় দুধ খেলে পেট খারাপ হয় কিনা বা দুধপানের অভ্যাস খাদ্যাভাস গঠনের পথে অন্তরায় কিনা তা নিয়ে গবেষণায় বসে যাওয়া। অতএব, কাউকে যদি কোন ব্যাপারে এমন কিছু বলতে শোনেন, যেখানে তার নিজের স্বার্থ বা নিজস্ব গরজ থাকার যথেষ্ট কারণ বর্তমান আছে, তাহলে তার কথা চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করবেন না, যতক্ষণ না যার প্রতি দরদ দেখানো হচ্ছে তার প্রতি তাদের সামগ্রিক ও সার্বক্ষণিক আচরণ ও মনোভাব প্রীতিকর বিবেচিত না হয়। যদি কোন বিষয়ের (যেমন- ধর্মের) অযুহাত দেয়া হয়, তাহলে উক্ত বিষয়ের প্রতি আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা (ধর্মের ক্ষেত্রে ধর্মনিষ্ঠা) সবসময় তার কেমন থাকে সেটা দেখে নিতে হবে। যদি কোন ব্যক্তি (যেমন- বাচ্চা) বা জাতির (যেমন- স্বদেশের জনগণের) কল্যাণের দোহাই দেয়া হয়, তাহলে সর্বদা সে/তারা কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণে বাচ্চার বা জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয় কিনা সেটা যাচাই করে দেখতে হবে।
বিশেষ করে নিজের স্বার্থের জন্য ধর্মের দোহাই দেয়াটা প্রতারকদের একটি প্রধান ও কমন বৈশিষ্ট্য। কোন মানুষকে যদি দেখেন, বাচ্চাদের প্রতি দয়াশীল, দায়িত্বশীল ও আন্তরিক না হয়েই শুধু "পিতামাতার কথা না শুনলে দোযখের আগুনে জ্বলতে হবে" টাইপের নসীহত দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে সাক্ষাৎ ভণ্ড প্রতারক ধর্মব্যবসায়ীদের দলেই গণ্য করবেন। কারণ, সে মুখে আল্লাহর কথা বললেও এবং আল্লাহর আযাবের ভয় দেখালেও তার নিজের মনে আল্লাহর ভয় নেই, আল্লাহকে সে একবিন্দু কেয়ার করে না, বরং আল্লাহর নাম ভাঙ্গিয়ে দুনিয়া কামাতে চায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যেসব পিতামাতা বা নেতা-মাতবর আল্লাহর ভয় দেখিয়ে নিজেদের আনুগত্য করতে মানুষকে বাধ্য করে, তারা মানুষকে দ্বীনদারি শেখানো বা আল্লাহর পথে মানুষকে চালিত করবার জন্য তা করে না, বা পারতপক্ষে দ্বীনের পথে মানুষকে চালিত করবার কোন তাগিদ বা প্রবণতা তাদের মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। যেমন- পিতামাতারা সাধারণত প্রচলিত লেখাপড়া ও পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করাবার প্রয়োজনে পিতামাতার আনুগত্যের বিষয়টা জোর দিয়ে তুলে ধরে এবং এর সাথে ধর্মকে যুক্ত করে। অথচ বাচ্চার পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে নিজের সুনাম কামানোটা totally ষোলআনাই পার্থিব স্বার্থ- এর মাঝে দ্বীনের কিছুই নেই। কিংবা পারতপক্ষে সন্তানের কল্যাণকামনার বিষয়টিও এখানে জড়িত নেই। শুধু ধর্মব্যবসায়ী প্রতারকগণই নয়, বরং এমনকি ধর্মবিদ্বেষী মুনাফিকরাও মানুষকে ধর্মের পথ থেকে সরিয়ে দেবার কাজে ধর্মের দোহাই দিয়ে থাকে। আমি এমন তাগূতী মহিলাকেও দেখেছি, যে নিজের বাচ্চাকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করে, কিন্তু নিজের অনুকূলে আনুগত্য লাভের প্রয়োজনে আল্লাহর নামকেই ব্যবহার করে। সরলমনা অবুঝ বাচ্চাকে প্রতারিত করবার উদ্দেশ্যে সে তার বাচ্চার শারীরিক অসুস্থতাকে মাতার অবাধ্যতা হেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত শাস্তি হিসেবে তুলে ধরে এবং এর জন্য বাচ্চাকেই আল্লাহর কাছে এই মর্মে তওবা করতে বলে যে, "আমি আর মায়ের অবাধ্য হব না, এখন থেকে মায়ের সব কথা শুনব, অতএব আমাকে ভালো করে দাও।" অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে ঐ বাচ্চার পক্ষে মায়ের কথা শোনা বলতে বাস্তবে কার্যত মায়ের কথামতো বমি ভক্ষণ করা এবং ঈমানদার ভাই-বোনদের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ ও মারামারিতে লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। আর পরবর্তী জীবনে পরিণত বয়সে মায়ের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ বলতে মুসলমানদের মাঝে খুন-খারাবি, হানাহানি ও ফেতনা-ফাসাদে জড়িত হওয়া ছাড়া আর কোন অর্থই দাঁড়ায় না। অতএব, কেউ কখনো ধর্মের দোহাই দিলেই তা সাথে সাথে গ্রহণ করা যাবে না, বরং সে আসলে ধর্মে বিশ্বাসী কিনা ও আল্লাহর অনুগত কিনা এবং সেই সাথে তার আকাঙ্ক্ষা ও কামনা ধর্মের জন্য নিবেদিত নাকি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ব্যক্তিগত কোন অশুভ উদ্দেশ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট, তা আগে বুঝে নিতে হবে। ধর্মদ্রোহী মুনাফিকরা নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতে বাধাদানের ক্ষেত্রে লেখাপড়া ও জীবনের নিরাপত্তার দোহাই দিলেও আসলে লেখাপড়া বা জীবনের নিরাপত্তা তাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং ধর্মের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখাটাই তাদের উদ্দেশ্য।
(৬) প্রতারকরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মনগড়া তত্ত্ব প্রচার করে থাকে। তাদের মনগড়া কথা ধর্মের নামেও হতে পারে, আবার চিকিৎসাবিজ্ঞানের নামেও হতে পারে। ধর্মের নামে মনগড়া কথার প্রচার জাল হাদীসের মাধ্যমেও হতে পারে, আবার কাল্পনিক কেচ্ছা-কাহিনীর মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন- "যে যুগের ইমামকে চিনল না, সে কাফের হয়ে মরল।" চিকিৎসাবিজ্ঞানের নামে নিজের স্বার্থে যে ধরনের ভুয়া কথার প্রচার হতে পারে, তার উদাহরণ হল- "বাচ্চা হওয়ার পর দেড় বছর পর্যন্ত দূরে কোথাও যাওয়া যায় না।" প্রতারকদের মনগড়া মিথ্যাচার ধরা পড়ে যায় তখনই, যখন ভিন্ন ক্ষেত্রে স্থান-কাল ও পাত্রভেদে তাদের ফয়সালা পাল্টে যায়। যেমন, একজনের ক্ষেত্রে দেড় বছরের তত্ত্ব জাহির করবার পর আরেকজনের ক্ষেত্রে যখন আবার বলা হয়, "বাচ্চা হওয়ার পর তিন মাসে একটু হাওয়া পাল্টাতে হয়", তখন তাদের আগের কথার অসারতা ও জালিয়াতি স্পষ্ট হয়ে যায়। মনগড়া তত্ত্ব নিয়ত পরিবর্তনশীল। পাত্র বিচারে এটা নিমিষে বদলে যেতে পারে। যেমন- প্রসূতির স্বাস্থ্য ও শিশুর বর্ধনের জন্য বিশ্রাম গ্রহণটা উপযোগী হবে, নাকি শুয়ে থাকাটা ক্ষতিকর হবে, এটার ফয়সালা নির্ধারিত হবে ব্যক্তি বিচারে। অর্থাৎ, প্রতারক ব্যক্তি কাকে সুবিধা দেবে, আর কার কাছ থেকে সুবিধা আদায় করবে, তার নিরিখেই নির্ধারণ করবে কোন্‌ রোগীর জন্য কোন্‌ পথ্য দেয়া যায়।
(৭) সত্য গোপন করা এবং সত্যের বিপরীত তথ্য প্রকাশ করা প্রতারকদের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিজের চরিত্র, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ভূমিকা, অন্যদের সাথে তার সম্পর্ক ও আচরণ, নিজের ও নিজের সাথে জড়িত (related) অন্যান্যদের অবস্থা ইত্যাদি ব্যাপারে প্রকৃত চিত্র তুলে না ধরে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত তথ্য প্রচার করে। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য; ভালোকে মন্দ, মন্দকে ভালো; অত্যাচারীকে সেবক, আর সেবককে অত্যাচারী; জালেমকে মজলুম, মজলুমকে জালেম; দয়াশীলকে নির্দয়, নির্দয়কে দয়াশীল; সুখীকে দু:খী; দু:খীকে সুখী; শোষকতে ত্যাগী, শোষিতকে ভোগী; ভিকটিমকে বেনিফিসিয়ারী, আর বেনিফিসিয়ারীকে ভিকটিমরূপে তুলে ধরে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা টাউট, তারা আপনাকে উত্তমরূপে গজ দিয়ে দেবার পরও এমন ভাব দেখাবে, যেন আপনার পিছনেই সে যত সময়, অর্থ ও এনার্জি ক্ষয় করেছে; আপনার মাল মেরামত করতে গিয়ে নিজের আরো তিনটা মাল নষ্ট করে ফেলেছে; শুধু নেহায়েত ভালবাসা আর সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে আপনার কাজটা করে দিল ইত্যাদি। আপনাকে ঠকিয়ে নিজে লাভবান হলেও মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়াবে, আপনার প্রতি সে কত অনুগ্রহ করছে, আপনাকে বড়লোক বানিয়ে দিচ্ছে। ঘরের গিন্নীদের মধ্যে যারা একটু প্রতারক টাইপের, তারা ছেলের বউ অবস্থায় শ্বাশুড়ী-ননদের থেকে বেশি সার্ভিস পেয়ে ও নিজে তুলনামূলক কম সার্ভিস দিয়ে আসলেও এবং শ্বাশুড়ী অবস্থায় ছেলের বউকে উত্তমরূপে নিংড়ে খেয়ে বাচ্চাসহ অসুস্থ বানিয়ে দিলেও মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়াবে যে, বউ অবস্থায় নিজে যেরূপ কষ্ট করে নিজের জীবনটা বরবাদ করে এসেছে, নিজের ছেলের বউয়ের উপর সেই তুলনায় ফুলের টোকাটিও লাগতে দেয়নি, নিজের কারণে নিজের মত কষ্ট আর কেউ ভোগ করুক এটা চায়নি বলেই সে মানুষকে অনেক সুযোগ ও ছাড় দিচ্ছে। পুত্রবধু এমনকি পুত্রের ঘরের নাতি/নাতনির উপর নিজের যত হিংসা-বিদ্বেষ, বৈষম্য ও বৈরী মানসিকতা আছে, সব চাপা দিয়ে মানুষের প্রতি তার সেবা ও অনুগ্রহের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরবে যে, মানুষ শুনে মুগ্ধ হয়ে যাবে যে, আহা! জগতে এনার মত শ্বাশুড়ীই আর হয় না। সব মিলিয়ে বউকে কতটা রাজার হালে রেখে জামাই আদরে লালন-পালন করছে, নিজেই বরং বউকে গোষ্ঠীশুদ্ধ রান্না করে খাওয়াচ্ছে- এমন একটা ভাব দেখাবে, আর তা যথাসম্ভব সবাইকে বিশ্বাসও করিয়ে ছাড়বে। কখনো নিজের জন্য বা নিজের প্রিয় কারো জন্য কিছু তৈরি করে বা করিয়ে (নিজে হোক, অন্য কারো দ্বারা হোক, বা খোদ আপনার দ্বারাই তৈরি করানো হোক) আপনার কাছে দাবি করবে, আপনার জন্য বা আপনার বাচ্চার জন্য তৈরি করেছে। আবার কোন কোন খচ্চর মহিলা আছে, প্রবাসী স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পদ
পরকীয়া শয্যাসঙ্গী নিয়ে নিজের সুখ-সম্ভোগে ব্যয় করা এবং একমাত্র
শিশুপুত্রটিকে অনাহারে শুকিয়ে কাঠ বানিয়ে ফেলার পরও মানুষের কাছে প্রচার
করে বেড়াবে, সে নিজে কিছুই খায় না, সব শুধু খাদক বজলুটাকেই খাওয়ায়। অপরদিকে কোন কোন বেয়াদব বউ আছে, স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ী কারো সাথে ঝগড়া হলে তার বিবরণটা খণ্ডিত ও একপেশেভাবে প্রকাশ করে এবং নিজের সন্ত্রাসী আচরণের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে নিজের হাজারো আগ্রাসী বাক্যবানের দ্বারা প্ররোচনা দিয়ে বের করা প্রতিপক্ষের দু'একটি কথাকেই রাষ্ট্র করে দিতে শুরু করে। তার ভাবখানা এমন হয় যে, আমি শুধু (স্বামীকে) একটা ভাল সৎ পরামর্শ দিয়েছিলাম বা কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, বা (শাশুড়ীকে) রান্নার ব্যাপারে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, বা (শ্বশুড়ের কাছে) ছেলের প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম, আর তাতেই খামাখা আমাকে যা তা বলেছে, আমাকে অসভ্য-বেয়াদব বলেছে ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী বাচ্চার ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে শতভাগ আন্তরিক হলেও এবং আল্লাহর নাম-পরিচয় থেকে শুরু করে নামায-কালাম বাচ্চাকে আদর ও সদ্ব্যবহারের দ্বারা শিখিয়ে আসলেও এবং তার বিপরীতে স্ত্রীর ভূমিকা সর্বদা কার্যত বাচ্চার ধর্মশিক্ষার প্রতি বৈরী হওয়া সত্ত্বেও রাতারাতি হঠাৎ করে কোন একদিন ধর্মদরদী সেজে বাচ্চাকে মেরে-বকে আলিফ-বা ও কায়দা পড়তে বসিয়ে দিয়ে বাহাদুরী দেখাতে শুরু করে, আর দাবি করে, "আমি আরবী পড়াতে না বসালে পড়ানোই হয় না, তুমি নিজে তো পড়াতে পারই না, উল্টো আমাকে বাধা দাও।" আবার একদল লোক আছে, প্রতিপক্ষের নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে সম্পূর্ণ বিনা দোষে চাপা মার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েও মানুষের কাছে প্রচার করে, ওরাই শুধু যত তাণ্ডব করেছে, আর আমরা ওদেরকে সযত্নে সসম্মানে জামাই আদরে যার যার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি, এমনকি যারা পথ-ঘাট কিছুই চেনে না তাদেরকেও তাদের বাড়ির লাইনের বাস-ট্রেনের স্টেশনটা চিনিয়ে দিয়েছি, টিকেটটাও কেটে দিয়েছি একেবারে বিনে পয়সায়! আবার আরেকদল আছে, মানুষের উপর পেট্রোল মারতে এসে বাসের চাপায় আহত হয়ে ধরা পড়ার পর দাবি করে, পুলিশ আমাদের লোককে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে এসেছে। আবার যারা বলে, আমরা শুধু একটু বিজ্ঞান চর্চা করতে চেয়েছিলাম, আর তাতেই মানুষ আমাদের ফাঁসি চাইতে শুরু করে দিল; তারাও সত্য গোপনকারী, সত্যের অপলাপকারী।
আসলে যারা বিনা প্রয়োজনে ঠাণ্ডা মাথায় যেচে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলতে পারে, আসল সত্যকে জেনেশুনে বিকৃত করতে পারে, তারা প্রয়োজনে মানুষ খুনও করতে পারে। একজনকে খুন করে তার দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়েও দিতে পারে। তাই এসব ব্যক্তির থেকে সবসময় সাবধান থাকা দরকার।
(৭) প্রতারকরা সবসময় দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে এবং তাদের আচার-আচরণ দ্বিমুখী হয়ে থাকে। তারা কখনো একই নীতির উপর স্থির থাকতে পারে না। সকল সময় সবার ক্ষেত্রে একই নীতি প্রয়োগ তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বরং স্থান, কাল ও পাত্রভেদে তাদের মন-মানসিকতা, কথাবার্তা ও কার্যকলাপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। মানুষ পরের দু:খের চেয়ে নিজের দু:খটা একটু বেশি অনুভব করবে এটা স্বাভাবিক। একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকলে সেটাকে স্বাভাবিক মানবীয় দুর্বলতা হিসেবে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু নিজের ও পরের দু:খ বোঝার ব্যবধানটা যখন স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে অনেক বৃহত্তর মাত্রায় দেখা যায়, তখন এটাকে দ্বিমুখী চরিত্র হিসেবেই ধরা যায়। দ্বিমুখী লোকদের ক্ষেত্রে অনুভূতি হয়ে থাকে অসম্ভব রকমের আপেক্ষিক। তারা পরের কষ্টকে আদৌ কোন কষ্ট বা সমস্যাই মনে করে না, কিন্তু নিজের সামান্য কষ্টকেই বড় করে দেখে। এদের স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার উদাহরণ হল একদিকে নিজের কারণে অন্যান্য মানুষ সব পুড়ে মরতে দেখেও নির্বিকার থাকা, অপরদিকে নিজের ছেলের স্বাভাবিক মৃত্যুতেও অজ্ঞান হয়ে পড়া। এছাড়া কোন রাষ্ট্র বা সম্প্রদায় যদি আশপাশের দেশগুলোতে গণতন্ত্র ও ইসলামী বিপ্লব রফতানি করলেও নিজের কোল ঘেষা শুধু একটিমাত্র দেশকে এর আওতার বাইরে রাখে, গণতন্ত্র ও ইসলাম গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়, তাহলে এটাও দ্বিমুখী নীতির সবচেয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। যে তোমাকে কথায় কথায় গলা কেটে বা গলা টিপে হত্যার অভিলাষ প্রকাশ করেছে, হত্যার চেষ্টাও কম করেনি; হত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন যেমন নিয়মিতভাবে করেছে, তেমনি নাশকতামূলক অঘটনও কম ঘটায়নি; সে-ই যখন তোমার প্রাণনাশের আশংকার ধোঁয়া তুলে মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত রাখে, তখন সেটাকে মুনাফেকী, ভণ্ডামী আর দ্বিমুখী নীতিরই প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেবে। আবার বাড়ির পাশের মসজিদে যাওয়াটাকে যে শুধু রাতের অন্ধকারের দোহাই দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করেছে, সে-ই যখন কোন মারামারি-হানাহানির মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তোমাদের কাউকে নিয়োগ দিতে চাইবে, সেটাকে.. দ্বিমুখী নীতির ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে আমার "বিভ্রান্ত দল চেনার উপায়" শীর্ষক অপর একটি লেখার ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে।
(৭) মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল, মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে নিজের সন্তানকে এবং বড় মানুষের তুলনায় বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা, দয়া-মায়া ও অনুরাগ একটু বেশি থাকে। কিন্তু কাউকে যদি দেখেন, নিজের সন্তানের প্রতি দুর্ব্যবহার বা উদাসীনতা প্রদর্শন করছে, কিন্তু অন্যদের প্রতি যেচে দরদ দেখাচ্ছে; কিংবা বাচ্চাদের প্রতি কঠোর হলেও বড়দেরকে অতিরিক্ত খাতির-যত্ন ও আদর-আস্তিক করছে; তাহলে বুঝবেন, এ আচরণ আন্তরিক নয় বরং বিশেষ কোন উদ্দেশ্য হাসিলের নিমিত্তে পরিচালিত। এ ধরনের কৃত্রিম দরদের সর্বনিম্ন লক্ষ্য হতে পারে মানুষের কাছে ভাল সাজা ও প্রশংসা-সুনাম অর্জন করা। মাঝারি মানের লক্ষ্য হতে পারে মানুষকে পটিয়ে সম্পত্তি বা অন্য কোন পার্থিব সুবিধা হাসিল করে নেয়া। আর সর্বোচ্চ লক্ষ্য হতে পারে মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে কুমন্ত্রণা দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া, বা দ্বীনের পথ তথা ধর্মকর্ম থেকে সরিয়ে দেয়া ও ঈমানহারা করা, কিংবা পারতপক্ষে নিজের ধর্মদ্রোহিতা, অনাচার ও জুলুম-অত্যাচারের পক্ষে অনুমতি, লাইসেন্স এবং সম্ভব হলে সক্রিয় সহযোগিতা ও সর্বাত্মক সমর্থন আদায় করা।
মনে করুন, আপনার স্ত্রী যদি বাচ্চার প্রতি সদ্ব্যবহারকারী না হয়েও আপনার প্রতি আপনার মায়ের অবহেলা নিয়ে পেরেশানী দেখায়, আপনার মা যদি আপনার শিশুসন্তানের প্রতি কৃপণতা বা বিরূপ মনোভাব পোষণ করলেও আপনার প্রতি বেশি যত্নবান হয়, আপনার শিশু-নির্যাতনকারী স্ত্রী যদি আপনার ভাই বা ভাতিজা আপনাকে ব্যবসায়ে ঠকালো কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ-অস্থিরতা দেখায়, আপনার প্রতিবেশী মহিলা যদি নিজের বাচ্চাকে ঘরে তালা মেরে রেখে এসে যেচে আপনার সাংসারিক কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, তাহলে এগুলোকে উদ্দেশ্যমূলক বলেই জানবেন। কারণ, যে লোক বা মেয়েলোক বাচ্চাদের প্রতিই দয়া দেখাতে জানে না, সে বড় মানুষের প্রতি সমব্যথী হবে- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। (নিজের) স্বার্থ হাসিল বা (পরের) অমঙ্গল সাধন ছাড়া তার আর কোন মোটিভ থাকতে পারে না। তবে কেউ যদি দারিদ্রের কারণে নিজের ও সন্তানের আহার যোগানোর তাগিদে নিজের বাচ্চাকে ফেলে রেখে অন্যের বাচ্চা পালনের চাকুরী নেয়, তার কথা ভিন্ন। এছাড়া আমাদের নবীর (সা:) সাহাবায়ে কেরাম যে সবকিছুর চাইতে রসূলুল্লাহ (সা:)-কে বেশি ভালবাসতেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারটা প্রযোজ্য নয়। কারণ, নবীজী (সা:) বাস্তবেই আমাদের সন্তান-সন্তুতি অপেক্ষা অধিক ভালবাসা লাভের যোগ্য এবং তাঁর প্রতি সাহাবাদের ভালবাসাও কোনরূপ লোক দেখানো বা উদ্দেশ্যমূলক ছিল না, বরং খাঁটি আন্তরিক ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কেউ যদি নিজের নিষ্পাপ শিশুদের চেয়ে অন্য কোন সাধারণ মানুষের প্রতি বেশি দরদ দেখায়, তাহলে সেক্ষেত্রেই কেবল সেটা সন্দেহ ও প্রশ্নের উদ্রেককারী বিষয় বলে গণ্য হবে। অবশ্য কোন পরিস্থিতি বা বিপদের কারণে যদি অন্য কোন মানুষ নিজের শিশু সন্তানের তুলনায় অধিক বিপন্ন ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, তখন খাদ্য বা ঔষধ নিজের শিশুকে না দিয়ে ঐ ব্যক্তিকে দেয়াটা ভণ্ডামীর পর্যায়ে পড়বে না।
(৮) মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিকতা ও মন-মেজাজের কারণে একেক সময় একেক রকম আচরণ হতেই পারে। এছাড়া আপনার অবস্থা ও কার্যকলাপের প্রেক্ষিতেও আপনার প্রতি কারো আচরণ পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তেমন কোন বোধগম্য কারণ ছাড়াই যদি দেখেন, কেউ একসময় ঠাণ্ডা মাথায় আপনার উপর নির্যাতন ও শত্রুতামূলক আচরণ করছে, সামনে-পিছনে আপনার বিরুদ্ধে অন্যান্য মানুষকে উত্তেজিত করছে, পরিকল্পিতভাবে আপনাকে হেয় ও ক্ষতিগ্রস্থ করার লক্ষ্যে কাজ করছে; আরেক সময় সেই একই ব্যক্তি যদি আপনার সাথে মধুর ব্যবহার করতে শুরু করে, আপনার প্রতি খাতির-যত্ন ও আদর-আস্তিক দেখাতে শুরু করে, আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, আপনার কাছে অন্য কারো বদনাম করতে ও অন্য কারো বিরুদ্ধে আপনাকে উত্তেজিত করতে শুরু করে, আপনার সদুপদেশদাতা ও হিতৈষী বনে যায়; তাহলে তাকে মিথ্যাবাদী প্রতারক জালেম মুনাফিক ছাড়া কিছুই ভাববেন না। সে মূলত আপনার অনিষ্টকামী কুমন্ত্রণাদাতা 'ওয়াসওয়াসিল খান্নাস' মাত্র। সে যদি আপনার বন্ধুই হতো, তাহলে আপনার দুর্বল ও শক্তিশালী অবস্থা তথা সর্বাবস্থাতেই ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার ক্ষতি করা বা আপনাকে কষ্টদান করা থেকে বিরত থাকত। আপনার দুর্বলতার কোন সুযোগ কখনো নিত না। কিন্তু এ শ্রেণির প্রতারকদের ধর্মই হল, তারা শুধু অনিষ্টসাধনের কৌশল পাল্টায় মাত্র। উদ্দেশ্য হাসিলটা কখনো সরাসরি নিজের হাত দিয়ে করে, কখনো অন্য কাউকে দিয়ে করায় আর নিজে সাধু থাকে। কখনো আপনার বিরুদ্ধে অন্যকে ক্ষেপাবে, আবার কখনো আপনাকে অন্য কারো বিরুদ্ধে ক্ষেপাবে। শৈশবে যে তোমাকে লাথি-পাছাড় ও গলাটিপ ছাড়া আর কিছুই দেয়নি, বমি ছাড়া আর কিছুই খাওয়ায়নি, কৈশোরে সে-ই যদি তোমাকে দু'হাত ভরে দান করতে শুরু করে, তখন তার পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখো। হতে পারে তোমার বাবার পকেট খালি করা বা তোমাকে কোন বিপথে বা বিপদে চালিত করার পরিকল্পনা এখানে কাজ করছে। শিশুকালে তোমরা কেউ একটা কমলা খেলে যে ব্যক্তি 'খাদক বজলু' বলে উপহাস করেছে এবং বজলুকে কমলা খাইয়ে নিজে যে বদান্যতার পরিচয় দিয়েছে সে ব্যাপারটি ঘরে ঘরে ঘুরে বলে বেড়িয়েছে, সেই ব্যক্তি যখন তোমাদের গ্রামের জমির মোটা চাল থাকতে আহলাদ করে দামী চিকন চাল কিনে খাওয়ায়, তখন বুঝবে, তোমাদের বাবাকে ফতুর করা এবং তোমাদের কাছে নিজে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করাই তার উদ্দেশ্য। পাশাপাশি তোমাদেরকে এবং তোমাদের বাবাকে সমাজে সকলের চোখে হেয় ও অপাংক্তেয় করে তোলার লক্ষ্যটিও পূরণ হবে তোমাদেরকে অপব্যয়ী ও বিলাসী হিসেবে দেখাতে পারলে। যে তোমাকে আদর-স্নেহ-ভালবাসা তো দূরের কথা, ভুলেও এক মুহূর্তের জন্য মানবিক সহানুভূতিও দেখায় নি, সে-ই যখন তোমাকে অন্যদের কাছে আদর ও আশ্রয় পেতে দেখে অন্যদের নিরাপদ আশ্রয় ও ভালবাসার বন্ধন থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করবার উদ্দেশ্যে নিজে আগ বাড়িয়ে যেচে আদর-সোহাগ করতে শুরু করে; তখন তাকে কোনভাবেই বিশ্বাস করো না। যে তোমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে, সে-ই যখন দু'বছর পর তোমাকে রাতের বেলা মসজিদে যেতে দেখে 'মাতৃস্নেহের'(!) দুশ্চিন্তায় দু'নয়নের জলে বুক ভাসিয়ে দেয়, তখন সেটাকে শয়তানী ছাড়া আর কিছুই ভাববে না। তোমাদের কারো বাড়ির পাশের মসজিদে যাওয়াটাকে যে ব্যক্তি ঝুঁকিপূর্ণ সাব্যস্ত করে রুখে দিয়েছে, দশ বছর পর সেই একই ব্যক্তি যখন তোমাদের কাউকে কোন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত করে প্রকাশ্য ও নিশ্চিত বিপদের দিকে ঠেলে দেবার জন্য পাগল হয়ে ওঠে, তখন তার দরদ ও মায়াকান্নার স্বরূপটা চূড়ান্তরূপে নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়। যে তোমার বাবাকে সবেমাত্র ফতুর বানালো, সে-ই যখন তোমার চাকরির জন্য তদবির শুরু করে, তাহলে বুঝবে, এ তোমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিদানের কোন প্রয়াস নয়, বরং তোমাদেরকে নতুন করে কোন বিপদের সম্মুখীন করারই পায়তারা মাত্র। হতে পারে, তার নির্যাতনের ফলে সৃষ্ট তোমার শারীরিক ও মানসিক দুরবস্থা বর্তমান থাকা অবস্থায় তুমি কোন কর্মস্থলে বা মানব সমাজে গিয়ে স্বস্তিবোধ করবে না, তাই তোমাকে বিব্রত ও অপদস্থ করাই তার অভিপ্রায়। অথবা হতে পারে, এ তোমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লাগানোর নতুন কোন অভিসন্ধি। কারণ, তোমাদের এক ভাই যদি উপার্জন করে অন্য দুই ভাইকে খাওয়ায় এবং পরবর্তীতে এর প্রতিদান না পায়, তখন ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য ও রেষারেষি অনিবার্য। অপরদিকে তুমি যদি তোমার উপার্জিত টাকার পুরোটা সংসারে দিয়ে দিতে না চাও, তাহলে সেটাও হবে তোমাকে কৃপণ ও দায়িত্বহীন আখ্যা দিয়ে তোমার বাকি দুই ভাইকে তোমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার একটা মন্ত্র। আপনার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অবস্থায় আপনার সম্পদ যতদ্রুত সম্ভব ফুরিয়ে ফেলে আপনাকে দেউলিয়া বানানোর চেষ্টায় যে কোন ত্রুটি করেনি, সে-ই যখন আবার কে আপনার সম্পদ আটকে রাখল, কে আপনার কাছে বাড়িভাড়া চাইল এসব নিয়ে দরদে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, তখন তা আপনাকে বিপদের উপর বিপদে ফেলার প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব, পরনিন্দুক চোগলখোর দুর্বৃত্তদের কখনো প্রশ্রয় দেবেন না।
উপকারী বন্ধুর পক্ষে কি প্রাণঘাতী শত্রু হওয়া সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, যে ব্যক্তি আন্তরিক ও নি:স্বার্থভাবে [অর্থাত নিজে কোন ব্যক্তিগত বিনিময় ও লাভের আশা কিংবা আপনাকে তার নিজের মত ও পথে (এখানে ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাস ও মতাদর্শের কথাই বোঝাচ্ছি) চালিত করবার উদ্দেশ্য ছাড়াই] আপনার উপকার করেছে, তার ক্ষেত্রে বড় কোন গুরুতর কারণ বা পরিবর্তন ছাড়া আপনার শত্রুতে রূপান্তরিত হবার আশংকা নেই বলেই আমরা আশা করতে পারি। কিন্তু যে ব্যক্তি আদৌ আদতে আপনার কল্যাণকামী ছিলই না, বরং নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এবং আপনাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে আপনাকে নিজের অশুভ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করবার জন্যই আপনার সাথে সদ্ব্যবহার ও আপনার উপকার করেছে, সে ব্যক্তি যেকোন সময় নিজের স্বরূপ ধারণ করে সরাসরি আপনার সাথে শত্রুতা শুরু করে দিতে পারে, অথবা উপরে ভাল সেজে থেকে গোপনেও আপনার চৌদ্দটা বাজিয়ে দিতে পারে। প্রথমজনের উদাহরণ হচ্ছে কিরণমালা, আর দ্বিতীয়জনের উদাহরণ হচ্ছে রাজকুমারী মোহিনী নামধারী ছদ্মবেশী নাগিনী।
৯। মানুষের কল্যাণ সাধনের চেয়ে মানুষকে সন্তুষ্ট করার দিকে এদের বেশি মনোযোগ থাকে। কারো কথাবার্তা ও হাবভাবে যদি এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় যে, সে একাই আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী আপনজন, সে একাই আপনাকে ভালবাসে, আর অন্য সবাই (কিংবা তার বর্ণিত/নির্দেশিত/ইঙ্গিতকৃত সুনির্দিষ্ট কেউ কেউ) আদৌ আপনার ভালোই চায় না, সবাই শুধু আপনাকে ঠকায়- তদুপরি কোন কাজের কাজ কিছুর দ্বারা না হয়ে শুধু সস্তা আনুষ্ঠানিকতা ও আলগা আদিখ্যেতা দিয়েই আপনার কাছে নিজেকে প্রিয় ও অন্যকে অপ্রিয় বানাতে চায়, তাহলে এমন ব্যক্তি থেকে সাবধান! কারণ, "অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।"
১৩। প্রতারকদের একটি চরিত্র হলো, তারা জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃত ও সুপরিকল্পিতভাবে মানুষের ক্ষতি সাধন করে, কিন্তু তারপর আবার তাকদীরের দোহাই দিয়ে মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টা আল্লাহর উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়টা ধামাচাপা দেয়। প্রতারকদের মধ্যে যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য বা ব্যক্তিগত হিংসার জন্য অন্যের উপর শোষণ করে শারীরিকভাবে অসুস্থ বানায়, তারাও বলে মানুষের রোগ-ব্যাধি, সুস্থতা-অসুস্থতা সব আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়। আবার যারা মানুষের অনিষ্টকামী শয়তান হিসেবে ঠাণ্ডা মাথায় তিলে তিলে মানুষকে বিধ্বস্ত ও পঙ্গু করে দেয়, তারাও দাবি করে, মানুষের রোগ-শোক যা হয় সব আল্লাহই দিয়ে থাকেন। খোদাদ্রোহী প্রতারকরা আবার শুধু মানুষের অতীত ও ঘটে যাওয়া সর্বনাশের জন্যই আল্লাহকে দোষ দেয় না, বরং ভবিষ্যতে যে অনিষ্টটা সাধন করতে চাচ্ছে, তার দায়টাও অগ্রিম আল্লাহর উপর চাপিয়ে দিয়ে রাখে। এরা যখন কাউকে কোন বিপজ্জনক পেশায় যোগদানের জন্য প্ররোচিত করে, তখন কেউ তাদের সামনে এর ঝুঁকির দিকটা উল্লেখ করলেই সাথে সাথে এরা জবাব দেবে, হায়াত-মউত সব আল্লাহর হাতে। মৃত্যু যখন যেখানে যেভাবে লেখা আছে, তা এমনিতেই হবে। অথচ সে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার হীন পরিকল্পিত উদ্দেশ্যেই তাকে ওখানে পাঠাতে চাচ্ছে। নিজের অতীতের অন্যায়-অপকর্ম আর ভবিষ্যতের অশুভ নিয়তকে চাপা দেবার জন্য আল্লাহর ইচ্ছা ও তাকদীরের দোহাই দিলেও ধর্মের জন্য কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তো দূরের কথা, নামাযে যাবার মতন সহজ ও নিরাপদ কাজের অনুমতি দেবার বেলাতেও সে বিপদের গন্ধ পায়, সেক্ষেত্রে আর তাওয়াক্কুল ও তাকদীরের দোহাই চলে না। এই সমস্ত মুনাফিক ও ছলনাময়ীদের সামনে আমাদেরকে স্পষ্টভাবে একটা কথা ঘোষণা করতে হবে, হায়াত-মউত, সুস্থতা-অসুস্থতা সব আল্লাহর হাতে ও আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে একথা শতভাগ সত্য বটে, কিন্তু এই তাকদীরের বিধান কোন অপরাধীর চক্রান্ত ও মতলববাজিকে দায়মুক্তি দেয় না। ইচ্ছাকৃত অপরাধ যদি তাকদীরের দোহাই দিয়ে মার্জনীয় ও উপেক্ষণীয় হতো, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে কোন শাস্তির বিধানই থাকত না।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো যাদের মাঝে দেখবেন, তাদেরকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। তবেই সমাজ-সংসারে ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

PC Based MikroTik Router OS Installation

থাই লটারি কিভাবে খেলবেন

লটারি জেতার কার্যকরী কৌশল জানেন কি?টিপস ও ট্রিকস